বাংলাদেশে এক গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শহর থেকে গ্রাম—প্রতিটি স্তরের মানুষ আজ নানামুখী দুর্ভোগে দিন পার করছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের। প্রয়োজন মেটাতে বাধ্য হয়ে তারা নিজেদের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে।
শুধু সাধারণ জনগণ নয়, বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্প খাতও। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে থমকে গেছে বহু শিল্পকারখানার উৎপাদন চাকা। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা উৎপাদন ব্যয় সামলাতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে বাড়ছে বেকারত্ব—চাকরি হারাচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক।
ব্যাংক খাতেও চলছে তারল্য সংকট। সুদের হার বেশি হওয়ায় শিল্পোদ্যোক্তারা ঋণ নিতে পারছেন না। অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের টাকাও সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে আর্থিক খাতেও তৈরি হয়েছে অনাস্থা ও অনিশ্চয়তা।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং একের পর এক আন্দোলন দেশের সামগ্রিক পরিবেশকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় মব ভায়োলেন্স, চাঁদাবাজি এবং হামলার ঘটনা বাড়ছে। নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ।
এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়। বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু মন্তব্য করেছেন, “দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ এখন আইসিইউতে।” তিনি বলেন, বৈষম্য এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, “মানুষ এখন শুধু নির্বাচন নয়, নিজের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে বেশি চিন্তিত। এই উদ্বেগ নিরসন না হলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে পড়বে।”
শিল্প খাতের নেতারা বলছেন, বিদেশি শিল্পকে নানা সুবিধা দেওয়া হলেও দেশীয় শিল্পের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট সহায়তা নেই। এতে দেশীয় শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনেক শ্রমিক পরিবারে নেমে এসেছে অনাহার-দারিদ্র্যের ছায়া।
এছাড়া আবাসন খাতেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। রড-সিমেন্টের চাহিদা কমেছে, থেমে গেছে নতুন নির্মাণ প্রকল্প। এতে করে একপ্রকার স্থবিরতায় পড়েছে এ খাতটিও।
জেসিএক্স গ্রুপের কর্ণধার ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, “মার্কেটের টাকার প্রবাহ নেই। মানুষ কেনাবেচা করছে না। ব্যবসায়িক পরিবেশ একেবারে ভেঙে পড়ছে।”
শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশু জানান, “গত কয়েক মাসে বহু গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেছে। ঈদের আগেও শ্রমিকরা বেতন পাবে কি না তা অনিশ্চিত।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের রূপরেখা। দেশীয় শিল্প ও বিনিয়োগ রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
উপসংহার:
বর্তমানে দেশের সার্বিক অবস্থা এক সংকটকাল অতিক্রম করছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ পরিবেশ পুনরুদ্ধার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের কার্যকর পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি। নতুবা সংকট আরও ঘনীভূত হয়ে পড়বে—যার দায় বহন করতে হবে পুরো জাতিকে।