রাজবাড়ীর পদ্মা নদীতে ধরা পড়ছে আন্তর্জাতিকভাবে মহাবিপন্ন তালিকাভুক্ত বাগাড় মাছ। বিপন্ন হলেও মাছটি স্থানীয় বাজারে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে। মৎস্য ও বন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, আইনের অস্পষ্টতা এবং প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার ফলে এই মাছ সংরক্ষণের কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বাগাড় মাছ (Sperata spp.) আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (IUCN) রেড লিস্টে “Critically Endangered” বা মহাবিপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত। বাংলাদেশ সরকারের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের আওতায় এটি একটি সংরক্ষিত জলজ প্রাণি। আইন অনুযায়ী, এই মাছ ধরা, পরিবহন এবং বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সরোজমিনে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া পাইকারি মাছের আড়তে কয়েকদিন যায় এই প্রতিবেদক। দৌলতদিয়া বাস টার্মিনালের দক্ষিনে এই মাছের আড়ৎ। মাছের আড়তের পূর্বে দৌলতদিয়া নৌপুলিশের ফারি। ভোর থেকেই এই মাছ বাজারে পদ্মা নদীর বিভিন্ন ধরনের মাছ বিক্রি করতে আসে জেলেরা। আড়তে জেলেদের কাছ থেকে নিলাম পদ্ধতিতে মাছ ক্রয় করে ব্যবসায়ীরা। এই আড়তে ভোর বেলা পদ্মা নদীর পাঙ্গাস, কাতল, রিটে, বেলে, চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিয়ে আসে জেলেরা। মাঝে মধ্যেই এখানে জেলেরা বাগাড়র নিয়ে আসে। তবে বড় বাগাড় মাছ নিয়ে আসলে সেটি কেনার প্রতিযোগীতাই নেমে যায় ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি এই আড়তে ৫০ কেজি ওজনের একটি বাগাড় মাছ আড়তে নিয়ে আসে সিদ্দিকুর রহমান নামে একত জেলে। সেটি তার কাছ থেকে চান্দু মোল্লা নামে এক মাছ ব্যবসায়ী এক হাজার ৫৫০ টাকা কেজি দরে কিনে নেন। এভাবে প্রতিদিন দুই একটা করে বাগাড় মাছ আড়তে আসে। মাছ ব্যবসাযীরা জানান, নদীর মাছ হিসেবে বাগাড় মাছের চাহিদা অনেক বেশি ক্রেতাদের কাছে এজন্য প্রতিযোগীতা করে কিনতে হয়।
পদ্মা নদীর জেলেরা জানান, পদ্মায় সব মাছই এখন কমেছে। তবে ২০ বছর আগে যে পরিমান বাগার ছিল এখন নেই। এখন এই বর্ষা মৌসুমেই দুই একটা ধরা পরে। তবে এই মাছ ধরা নিষিদ্ধ কিনা সেটা তারা জানেন না।
মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলা থেকে মাছ ধরতে আসা ষাটউর্ধ্ব অনিল হালদার বলেন, আমি বেশ কয়েক বছর আগে ৮ কেজি ওজনের একটা বাগাড় পেয়েচিলাম পদ্মায়। তারপরও আর এই মাছ আমার জালে ওঠেনি। পদ্মায় যদি দুইশ নৌকা থাকে তাহলে দুই একজনের জালে বাগাড় মাছ ধরা পরে। সেটিও ছোট সাইজের। বড় আকারের বাগাড় এখন খুবই কম দেখা যায়। এই মাছ ধরা কি নিষিদ্ধ এই প্রশ্নের জবাবে অনিল বলেন, নিষিদ্ধ হবে কেন? নদীর সব মাছই সমান। মাছ ধরা আবার নিষিদ্ধ হয় নাকি। আমাদের কেউ কখনো বলেনি এই মাছ ধরা নিষিদ্ধ। তবে বাগাড় মাছ দিনে দিনে নদী থেকে নাই হয়ে যাচ্ছে।
বিধান হালদার বলেন, নদী অনেক মাছ এখন পাওয়া যায় না। তার মধ্যে এই বাগাড় একটি। তবে এই মাছ ধরা নিষেদ এটি আমি জানি না। আপনার কাছ থেকে প্রথম জানলাম। আর কারো জালো যদি বড় আকারের বাগাড় ধরা পরে তখন কি তিনি ছেড়ে দিবেন। এমন প্রশ্ন করেন বিধান।
দৌলতদিয়া ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী চান্দু মোল্লা বলেন, অনেক কষ্টমার আছে যারা ফোন করে বলে রাখে বাগাড় মাছ পেলে দিতে। আর নদীর বড় মাছের চাহিদা অনেক বেশি। এজন্য আমরা প্রতিযোগীতা করে বাগাড় মাছ কিনি। তবে এই মাছ নিষিদ্ধ কিনা সেটা আমি জানি না। আমাদের কেউ কখনো বলেনি।
দৌলতদিয়া নৌ পুলিশ ফারির ইনচার্জ ত্রিনাথ সাহা বলেন, আমরা জেলেদের বিভিন্ন সময় মৌখিক ভাবে নিষেধ করি নদী থেকে তোমরা এই মাছ ধরো না। এছাড়া আমরা উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়ে রাখি এই মাছ ধরছে ও বিক্রি করছে। এছাড়া কখনো বন বিভাগ আমাদের কাছে পুলিশ চাইলে আমরা সেটি দিয়েও সাহায্য করতে পারি।
রাজবাড়ী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, মৎস্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী যে নিদের্শনা দেওয়া আছে সেখানে বলা আছে ৩০ সেঃমিঃ পর্যন্ত পোনা ধরা যাবে না। সেখানে মাছ বড় হলে ধরা যাবে না এমন কোন কথা নেই। কিন্তু বাগাড় মাছ মহাবিপন্ন প্রাণি এটি ঘোষনা করেছে বন্য প্রাণি সংরক্ষণ বিভাগ। মৎস্য আইনে এই বিষয়ে কিছু বলা নেই। এজন্য এই আইন আমি সরাসরি প্রয়োগ করতে পারি না। আমরা জেলেদের বুঝাতে পারি এই মাছ তোমরা ধরো না। এই মাছ আমরা রক্ষা করি। আর আমি মন্ত্রনালয়কে জানাতে পারি আন্তমন্ত্রনালয় এই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাহিদুর রহমান বলেন, বাগার মাছের বিষয়টা মৎস আইনে নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু বন্য প্রাণি সংরক্ষণ আইনে বাগাড় মাছ ধরা নিসিদ্ধ।গোয়ালন্দ এলাকায় মাঝে মধ্যেই জেলেদের জালে এই মাছ ধরা পড়চে। এখানে যারা প্রসিকিউটিং অথরিটি তারা যদি অভিযোগ না দায়ের কওে তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। এই আইনটি বন বিভাগ প্রতিপালন করে থাকে কিন্তু রাজবাড়ীতে এই বিভাগের অফিসই নেই। এজন্য তাদের কাছ থেকে প্রসিকিউশন পায় না। আবার যে জেলের জালে এই বাগার মাছ ধরা পরে সে বিক্রি করে চলে যায়। এজন্য আমরা আপনাদের মাধ্যমে জেলে ভাইদের বলতে চাই এইটি মহাবিপন্ন প্রাণি। এভাবে ধরলে এই মাছ প্রকৃতি থেকে হাড়িয়ে যাবে। আপনারা এই মাছ ধরা থেকে বিরত থাকুন।
বন্য প্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, আজ থেকে ৫০ বছর আগে যে ভাবে বাগার মাছ নদীতে পাওয়া যেত এখন কিন্তু সেই ভাবে নেই। এজন্যই এই মাছ কে মহাবিপন্ন প্রাণির তালিকায় রাখা হয়েছে। এই মাছ আমরা সংরক্ষণ করতে না পারলে এক সময় প্রকৃতি থেকে হাড়িয়ে যাবে। এখন ব্যবস্থা নিতে পারে পুলিশ প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ। যেখানে আইনকরা হয়েছে এই মাছ ধরা নিষেধ। তারমানে মাছ ধরলে আইন ভঙ্গ করা হচ্ছে। আইন ভঙ্গ করলে তখন স্থানীয প্রশাসনই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আমাদের থাকা কেন লাগবে?
বাগাড় মাছ নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে জেলেদের মধ্যে এক ধরনের অজ্ঞতা এবং প্রশাসনের মধ্যে দায়সারা মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। কেউই স্পষ্টভাবে জানে না—এই মাছ ধরা নিষিদ্ধ কেন, এবং এই আইন কে প্রয়োগ করবে। ফলে প্রজাতিটি হারিয়ে যাওয়ার পথে। একটি মহাবিপন্ন প্রাণি যখন প্রতিদিন আড়তে বিক্রি হয়, তখন কেবল আইন বানালেই হবে না, তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করাও জরুরি। মৎস্য অধিদপ্তর, বন বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। না হলে খুব দ্রুতই প্রকৃতি থেকে বাগাড় মাছ হারিয়ে যাবে—যার মূল্য আমরা বুঝতে পারবো অনেক দেরিতে।