১৬ মে ২০২৫ — বাংলাদেশের গম আমদানিতে আবারও রাশিয়ার প্রাধান্য বাড়ছে। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই–এপ্রিল) আমদানিকৃত মোট গমের ৫৪ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে। সস্তা দাম ও স্থিতিশীল সরবরাহের কারণে রাশিয়া হয়ে উঠছে দেশের গম আমদানির প্রধান ভরসা। তবে এই নির্ভরতাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন বিশেষজ্ঞেরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, এ সময় দেশে গম আমদানি হয়েছে প্রায় ৪৯ লাখ টন, যার মধ্যে রাশিয়া থেকে আমদানির পরিমাণই প্রায় ২৬.৫ লাখ টন। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০০৬–০৭ অর্থবছরের পর রাশিয়া থেকে এটিই সবচেয়ে বেশি গম আমদানির রেকর্ড।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে গম আমদানির একটি বড় উৎস ছিল ইউক্রেন, যা থেকে বছরে গড়ে ২৩–৩০ শতাংশ গম আমদানি হতো। কিন্তু যুদ্ধের ফলে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সেই হার নেমে এসেছে ১৪ শতাংশে। এর ফলে রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা বেড়েছে।
দামের ব্যবধান বড় কারণ
গত এপ্রিল মাসে রাশিয়া থেকে টনপ্রতি গম আমদানি হয়েছে ২৫১ থেকে ২৬১ ডলারে, কেজিপ্রতি ৩১–৩২ টাকা। অন্যদিকে, উচ্চ আমিষযুক্ত গমের প্রধান উৎস কানাডা থেকে একই সময়ে টনপ্রতি দাম পড়েছে ২৯৮ থেকে ৩৩০ ডলার, অর্থাৎ কেজিপ্রতি ৩৬–৪০ টাকা। ফলে সস্তা গমের জন্য আমদানিকারকরা ঝুঁকছেন রাশিয়ার দিকে।
গুণগত পার্থক্য ও চাহিদা
বাংলাদেশে দুই ধরনের গম আমদানি হয়— সাধারণ (কম আমিষযুক্ত) ও উচ্চ আমিষযুক্ত। সাধারণ গম ব্যবহৃত হয় কেক, বিস্কুট, ও অন্যান্য বেকারি পণ্যে। এই গম কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের দেশ যেমন রাশিয়া থেকে আসে। আর উচ্চ আমিষযুক্ত গম ব্যবহার হয় পরোটা, পাস্তা, নুডলস তৈরিতে, যা আমদানি হয় কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া থেকে।
বর্তমানে আমদানি হওয়া গমের মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশ উচ্চ আমিষযুক্ত। কয়েক বছর আগে যেখানে এই হার ছিল ৩০ শতাংশ, সেখানে এখন সস্তা গমের কারণে উচ্চ মানের গম আমদানি হ্রাস পাচ্ছে।
নির্ভরতার ঝুঁকি
খাদ্যশস্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, “রাশিয়া থেকে আমদানিতে অনেক সময় ব্যাংকিং জটিলতা দেখা দেয়। যদিও খাদ্যশস্যের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, তবুও একক উৎসে নির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের বহুমুখী উৎসে নজর দেওয়া উচিত।”
বর্তমানে ব্রাজিল থেকেও কিছু পরিমাণ গম আমদানি শুরু হয়েছে, তবে তা মাত্র ২ শতাংশের মতো। এই প্রবণতা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন অনেকেই।
বিনিয়োগ ও পরিকল্পনার প্রয়োজন
দেশে গমের চাহিদার মাত্র ১৪–১৫ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, বাকি ৮৫ শতাংশ আমদানিনির্ভর। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে গম আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২০৫ কোটি মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসেই আমদানি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩৪ কোটি ডলার।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৈচিত্র্যময় উৎস থেকে আমদানি ও দেশে উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
উপসংহার
সস্তা গমের লোভে একক দেশের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধির মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে রয়েছে সরবরাহ সংকট ও দামের অস্থিরতার ঝুঁকি। বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশকে এখনই বহুমুখী আমদানি নীতির দিকে এগোতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায়।