নিজস্ব প্রতিবেদক
কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে কৃষি ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। তবে পুরুষের তুলনায় নারীর মজুরি বৈষম্য অন্য কর্মক্ষেত্রের তুলনায় কৃষি কাজে অনেক বেশি। কৃষি ক্ষেত্রে কাজ সমান করলেও নারীর মজুরি পুরুষের তুলনায় অর্ধেক।
রাজবাড়ীতে বর্তমানে ফসলের মাঠে পুরুষের সাথে নারী শ্রমিক অনেক বেশি দেখা যায়। পেঁয়াজের চারা রোপণ, ধানের চারা রোপণ, ফসলের ক্ষেত নিড়ানো, কুপানোসহ সব ধরনের কাজ নারী শ্রমিক করে থাকে মাঠে। এসব কাজ নারী শ্রমিক পুরুষের সমান করলেও মজুরি পান অর্ধেক। এতে অনেক নারী শ্রমিকের মাঝে ক্ষোভ দেখা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া, উজানচর, দেবগ্রাম ইউনিয়নের চরাঞ্চলে মুরি পেঁয়াজ রোপণ, বিভিন্ন ধরনের ফসলের ক্ষেত নিড়ানোসহ নানা কাজ পুরুষের সাথে নারী শ্রমিকরা করছে। দল বেঁধে এসব নারী শ্রমিক কোদাল দিয়ে ক্ষেতের মাটি আলগা করছে। কোনো ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করছে। আবার সবজির চারা রোপণ করছে। এসব নারী শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সকাল সাড়ে ৭টায় তারা মাঠে আসে। কাজ করে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। দুপুরে শুধু খাবারের বিরতি পান। এই কাজে তাদের মজুরি ৩৫০ টাকা। কিন্তু একই কাজে পুরুষ পান ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। নারীরা কোনো পুরুষ শ্রমিক থেকে কম করেন না। তারপরও মজুরি তাদের থেকে অনেক কম।
অনেক পুরুষ শ্রমিক জানান, নারীরা জমির আগাছা পরিষ্কার, কোদাল দিয়ে মাটি আলগা করা, পেঁয়াজের চারা রোপণ এসব কাজ পুরুষ শ্রমিকের সমান করে। তবে তারা মাথায় কোনো ভারী জিনিস নিতে পারে না। আর জমিতে কীটনাশক ছিটানোর মেশিন কাঁধে নিয়ে ক্ষেতে ছিটাতে পারে না। তবে অন্য সব কাজ পুরুষের সমান করে থাকে।
টমেটো ক্ষেতে কাজ করা চামেলী বেগম বলেন, “খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির রান্না করে সবার খাবার দিয়ে নিজের খাবার সঙ্গে নিয়ে মাঠে আসি। আমরা একজন পুরুষ মানুষের সমান কাজ করি। এই টমেটো ক্ষেতের মাটি কোপানোর কাজ করছি। আমার থেকে বেশি কাজ কোনো পুরুষ মানুষ করছে না। আমি শুধু মাথায় কোনো ভারী জিনিস নিতে পারি না। আর যদি বলে এই জমিতে ওষুধ (কীটনাশক) ছিটিয়ে দাও, সেটি পারবো না। কিন্তু কাজ আমি কম করি না। আমার সঙ্গে যে পুরুষ লোকটা কাজ করছে সে পাবে ৬০০ টাকা আর আমি পাবো ৩৫০ টাকা। আমাদের ঠকানো হয়। কিন্তু বেশি চাইলে তো কাজেই নেবে না। অভাবের সংসারে তাই এই বেতনেই কাজ করি বাধ্য হয়ে।”
সফুরা বেগম বলেন, “হিসেব করলে আমরা পুরুষ মানুষের থেকে বেশি কাজ করি। আমরা সকালে কাজে এসে শুধু দুপুরে খাবারের জন্য এই জমি থেকে বের হই। আর একজন পুরুষ মানুষ বিড়ি খাবে, নানা ওজুহাতে সে বিশ্রাম নেয়। আবার বাড়ি ফিরেও আমার সংসারের রান্না করতে হয়। আমি ওনাদের (পুরুষ শ্রমিকদের দেখিয়ে) থেকে কাজ কম করি না। তবে আমার টাকা কম। আগে আরো কম ছিল, এখন গড়ে ৫০ টাকা বেড়েছে।”
মনছের বেপারী বলেন, “আমরা একসাথেই কাজ করি। বোঝা টানা ছাড়া মহিলারা সব কাজই সমান পারে। কিন্তু জমির মালিক তো সমান টাকা দেবে না। তারা মনে করে পুরুষের যদি বলে ৪০ কেজি সার বাড়ি থেকে মাথায় করে জমিতে নিয়ে আস, সে নিয়ে আসবে। কিন্তু নারীকে বললে সে তো আনতে পারবে না। এই একটা জায়গায় সে পিছিয়ে, এজন্য টাকা কম পায়।”
টমেটো ক্ষেতের মালিক আক্তার শেখ বলেন, “নারীরা কাজে এসে ফাঁকি দেয় না, এটা সত্য। কিন্তু অনেক সময় বাড়িতে রান্না করে আসতে একটু দেরি হয়। আবার ফেরার সময় আগে যেতে চায়, বলে বাড়িতে গিয়ে রান্না করতে হবে। আমরা এসব বিবেচনায় নিয়েই তাদের কাজে নিয়ে থাকি। আগে মাঠে এত নারী শ্রমিক ছিল না। এখন দাম একটু বেশি, এজন্য নারী শ্রমিকও বেশি। তবে পুরুষের তুলনায় বেতন কম, এজন্য তাদের চাহিদাও একটু বেশি। তবে নারী-পুরুষের সমান বেতন হলে তখন আবার মানুষ পুরুষ শ্রমিকদের কাজে নেবে, নারীদের নেবে না।”
রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মোঃ শহিদুল ইসলাম বলেন, “রাজবাড়ী অঞ্চলে পেঁয়াজ আবাদ বেশি হয়। এছাড়া চরাঞ্চলে সবজির আবাদ বেশি। এসব কাজে অনেক শ্রমিক প্রয়োজন। এজন্য এখানে মাঠে নারী শ্রমিকদের কাজ করতে বেশি দেখা যায়। তবে নারী শ্রমিকদের বেতন বৈষম্য রয়েছে। আমরা প্রতিটি কর্মশালা ও মাঠ দিবসে এই বিষয়টি চাষীদের বোঝাই। তবে আগের থেকে কিছুটা কমেছে। এখন পুরুষদের অর্ধেকের থেকে একটু বেশি বেতন পায় নারীরা।”