গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে তদন্ত সংস্থা।
ছয় মাস ২৮ দিন ধরে চলা তদন্ত শেষে গতকাল সকালে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আনসার উদ্দিন খান পাঠান। প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার পাশাপাশি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’সহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে।
চিফ প্রসিকিউটর এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচটি গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি অভিযোগ প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথম অভিযোগ অনুযায়ী, ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের তাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের নির্মূল করতে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও অন্যান্য মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ সরাসরি তিনি দেন, যা তাঁর টেলিফোন কথোপকথনে প্রমাণিত হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা, ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে আহত করা, শিশু ও নারীদের ওপর সহিংসতা, এবং লাশ পুড়িয়ে দেওয়া সহ বিভিন্ন অমানবিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। আহতদের চিকিৎসা না দেওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগও প্রতিবেদনে রয়েছে।
এ ছাড়া তদন্ত সংস্থা দাবি করেছে, সরকার নিজেরাই সরকারি স্থাপনায় আগুন দিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছে। এসব কর্মকাণ্ডে শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশনার প্রমাণ রয়েছে বলেও জানানো হয়।
এ মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা রয়েছে। একটিতে তাঁর বিরুদ্ধে সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং অন্যটি ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত। উভয় মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পর্যায়ক্রমে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে।
এদিকে, উত্তরায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলামসহ আরও নয়জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ জুলাই।
সামগ্রিকভাবে, পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত দুটি মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন ধাপের সূচনা করেছে যেখানে ক্ষমতাসীন বা প্রাক্তন শাসকদের বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হতে যাচ্ছে।