রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ০৩:৫৮ অপরাহ্ন
রাজবাড়ী সদর উপজেলার রাজাপুর গ্রামে পানির মোটর চুরির অভিযোগ তুলে ঘর থেকে তুলে নিয়ে শাহিন শেখ ওরফে রুপল (৩০) নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। শুক্রবার (১৬ মে) সন্ধ্যায় এ নির্মম ঘটনা ঘটে। নিহত শাহিন শেখ ওই গ্রামের দিনমজুর ও ভ্যানচালক জিন্নাত শেখের ছেলে। তার দুই শিশু কন্যা রয়েছে—একজন সাত বছর বয়সী, অন্যজনের বয়স দুই বছর।
নিহতের পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, তিন মাস আগে শ্যাম বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে একটি পানির মোটর চুরি হয়। সেই চুরির অভিযোগে গত ১৩ মে (মঙ্গলবার) শ্যাম বিশ্বাসের ছেলে রাফিজুল ও তার পরিবারের সদস্যরা শাহিনকে মারধর করেন। মোবাইল চুরি কিংবা কোনো ভিডিও সংক্রান্ত প্রমাণ না পেলেও তাকে অভিযুক্ত করে নির্যাতন করা হয়। পরদিন নিরাপত্তার অভাবে শাহিন ঢাকা চলে যান।
এরপর স্থানীয় মাতব্বররা বিষয়টি সালিশে মীমাংসার আশ্বাস দিলে, শাহিনের মা রাবেয়া বেগম তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি বাড়ি ফেরেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় সালিশ হওয়ার কথা থাকলেও, তার আগেই রাফিজুল, রাসেল, সৌরভসহ ৭-৮ জন যুবক শাহিনকে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যান। এরপর শ্যাম বিশ্বাসের বাড়িতে আটকে রেখে তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় শাহিনকে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
শুক্রবার দুপুরে নিহত শাহিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি ভাঙাচোরা টিনের ছাপড়া ঘর, পাটকাঠি দিয়ে তৈরি বেড়া ভেঙে গেছে। ঘরের ভেতরে শুধু একটি কাঠের চৌকি। পুরো পরিবার থানায় অবস্থান করায় বাড়িতে এলাকাবাসীর ভিড়।
এদিকে, অভিযুক্তদের বাড়িতে গেলে শ্যাম বিশ্বাসের স্ত্রী রাহেলা পারভীন দাবি করেন, “আমাদের বাড়ির মোটর চুরি করেছে শাহিন। আবার আমার বৌমার ভিডিও করেছে। এজন্য আমার ছেলে ও অন্যরা তাকে মারধর করেছে।” তবে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “বাড়ির ভেতরে তখন অনেক লোক ছিল। গণপিটুনিতে মারা গেছে।” বৌমা জেসমিন আক্তার বলেন, “শাহিন শুধু মোটর চুরি করেনি, আমার জানালায় টোকা দিত, গান গাইত, ভিডিও করত।” প্রশ্ন উঠলে তিনি জানান, “বাটন ফোন দিয়েই ভিডিও করেছে, পরে মেমোরি ফেলে দিয়েছে।”
রাজবাড়ী সদর থানায় গিয়ে দেখা যায়, নিহত শাহিনের বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা থানার ভেতরে আমগাছের নিচে বসে আছেন। জিন্নাত শেখ বলেন, “আমার ছেলের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। সালিশে বিষয়টি মীমাংসা হওয়ার কথা ছিল। এর আগেই ওরা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা সবাই মিলেই মামলা করতে এসেছিলাম, কিন্তু শুনি আমার শালাই (কালাম মোল্লা) বাদী হয়ে মামলা করেছে। অথচ সে কিছু জানে না। মূল অভিযুক্তদের না ধরে যারা আমাদের পক্ষে, তাদেরই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আমি ন্যায়বিচার চাই।”
তবে মামলার বাদী শাহিনের মামা কালাম মোল্লা দাবি করেন, “পুলিশ রাতে আমাকে থানায় নিয়ে আসে, কিছু কাগজে নাম লিখতে বলে। আমি কিছু না বুঝেই লিখেছি। মামলার ব্যাপারে আমাকে কিছু জানানো হয়নি।”
রাজবাড়ী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহমুদুর রহমান জানান, নিহতের মামা বাদী হয়ে ১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৭-৮ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
তিনি আরও বলেন, “মূলত চুরির অভিযোগ থেকেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে।”
নিহতের পরিবার এ ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে পুলিশের প্রতি সঠিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
